খৈয়াছড়া ঝর্ণা ভ্রমন গাইড: কোথা হতে কিভাবে এবং প্রস্তুতি

খৈয়াছড়া ঝর্ণা ভ্রমন গাইড: কোথা হতে কিভাবে এবং প্রস্তুতি

ভ্রমণ বাংলা No Comments

প্রিয় পাঠক,

আসসালামু আলাইকুম

স্বাগত জানাচ্ছি চট্রগ্রামের সবচেয়ে উচ্ছল, প্রাকৃতিক আকর্শনীয় এবং লাইভ খৈয়াছড়া ঝর্ণা অভিযানে। অবস্থান চট্টগ্রামের মিরশরাই উপজেলার ঢাকা চট্টগ্রাম হাইওয়ে হতে ৩/৪ কিলোমিটার পূর্বদিকে।

আমি খৈয়াছড়া ঝর্না টুরের প্রতিটি দৃশ্য, খুটি নাটি এবং জানা-অজানা তথ্য আপনাদের সাথে শেয়ার করব তাই খৈয়াছড়া ঝর্না ভিডিও একটু দীর্ঘ হলেও পুরা ভিডিও দেখুন। এটি বাস্তবের মত উপভোগ্য হবে নিশ্চিত।

আসুন শুরু করি খৈয়াছড়া ঝর্ণা (মিরসরাই, চট্টগ্রাম) অভিযান !!

আলিফ হোটেলে সকালের নাস্তা

চট্টগ্রামের অলংকার মোড়ের আলিফ হোটেলে সকালের নাস্তা সেরে আমরা ৫ বন্ধু চয়েস পরিবহনের একটি গাড়িতে রওনা হই। ভাড়া মাথাপিছু ১০০ টাকা। প্রায় ৫০ মিনিটে আমরা পৌছে যাই ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ের খৈয়াছড়া পয়েন্টে।

Khoiyachara, Dhaka-Chattogram Highway

এখানে আমরা উচু-নীচু বন্ধুর রাস্তায় পায়ে যাতে কোন আঘাত না লাগে সেজন্য ৪৫ টাকা দরে ১ জোড়া করে এ্যাংকলেট ক্রয় করি। তার পর টং হোটেলে ১ কাপ চা, সাথে সিংগাড়া। খরচ ১০ টাকা করে।

হাইওয়ে টু ঝর্ণা ভাঙ্গা রাস্তা

মাথাপিছু ২০ টাকা ভাড়ায় সিএনজি তে উঠে পড়ি। ১০ মিনিটের রাস্তা। অর্ধেক রাস্তা কাচা, খুবই খারাপ অবস্থা, বাকি অর্ধেক কর্পেটিং করা, বেশ ভাল। জানা গেল খুব শীঘ্র এ রাস্তায় উন্নয়নের ছোয়া লাগবে।

১০ মিনিটের মধ্যে পৌছে যাই পার্কিং জোনে। এখানে গাড়ি পার্কিং করে রেখে আপনি ভ্রমন করতে পারেন।

প্রত্যেকে ১টি করে বাঁশের লাঠি কিনে নিই দাম ১০ টাকা। উচুনীচু রাস্তায় ব্যালেন্স রাখার জন্য এই লাঠি খুবই দরকারী। তাছাড়া পানির মধ্যে চলার সময় পানির গভীরতা মাপার জন্যও এই লাঠি আপনাকে সাহাজ্য করবে, কারন পানির গভীরতা কোথাও কম, কোথাও বেশী।

Wooden Bridge : Way to Khoiyachara Waterfalls
Another Wooden Bridge

যাওয়ার পথে কয়েকটি বাঁশ/কাঠের সাকো দেখা গেল।

কয়েকটি হোটেলও পাবেন যাওয়ার পথে।

Jhorna Hotel
Lunch @ Jhorna Hotel

আমরা উঠলাম ঝর্ণা হোটেলে।

এটি আসপাশের ভুমি হতে বেশ উচুতে তৈরী। গাছপালা, ফুল ও বাঁশঝাড়ে ঘেরা। রয়েছে ছাতায় ঘেরা বসার রাউন্ড টেবিল। এখানেই আমরা বিশ্রাম নিয়েছি, আড্ডা মেরেছি এবং লাঞ্চ করেছি। বেশ রোমান্টিক রোমান্টিক লাগে। খুব সীমিত মূল্যে অনেক ভাল খাবার পাবেন এই হোটেলে

যাহোক, এই হোটেলে আমরা ড্রেস চেঞ্জ করি।

আমাদের ড্রেস রাখার পর লকারের চাবি আমদের কাছে রাখি এবং ফেরার পথে এখানে গোসল, বিশ্রাম এবং লাঞ্চ সেরে আমরা ফিরে যাব।

লাঞ্চের অর্ডার আমরা আগেই দিয়ে দেই। ন্যাচারাল স্বাদের দেশী মুরগীর মাংশ, ডাল, আলু ভর্তা, সালাদ আর চা; মাথাপিছু ১৩০ টাকা খরচ।

এখন সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ (ভাদ্র মাসের ২য় সপ্তাহ)। আকাশ বেশ মেঘলা আবার কখনও কখনও রোদ; তবে প্রচন্ড ভ্যাপসা গরম।

বনের ফাকে মেঘলা আকাশ
মেঘলা আকাশ বন আর ঝর্ণার অপুর্ব সমন্বয়

আমরা যথেষ্ঠ পানি নিয়েছি, নিয়েছি শুকনো খাবার, কোক, কলা, বিস্কুট, চকলেট। এছাড়া আমার ব্যাকপ্যাকে আছে কিছু শুকনো খাবার, আধা লিটার পানি (অতি ইমারজেন্সির জন্য), একটি ছাতা, বৃষ্টিতে আমার ক্যামেরা এবং গেজেট সেইফ রাখার জন্য কয়েকটা প্লাস্টিক ব্যাগ।

আর ভ্রমনের শেষ দিকে গোসলের জন্য কাপড় চোপড় আমরা হোটেলের লকারেই রেখে এসেছি।  

আমরা ঝর্ণা হোটেল হতে রওনা হচ্চি আসল গন্তব্য খৈয়াছড়া খর্ণার দিকে। যাচ্ছে আরও অনেক পর্যটক। আমি হোটেলের নিচে ক্যামেরা নিয়ে অপেক্ষা করছি আমার টিমের ভিডিও করার জন্য কিন্তু ওদের দেখা না পেয়ে আবার যাই হোটেলে। হোটেল বয় বল্ল যে আমার টিম ইতিমধ্যে চলে গিয়েছে। আমি ধাক্কা খেলাম। কি আর করা। আমি দ্রুত গতিতে ছুটলাম টিমের সাথে জয়েন করার জন্য। কাধে ব্যাগ, হাতে ভিডিও ক্যামেরা, অন্য হাতে লাঠি নিয়ে বন্ধুর কর্দমাক্ত রাস্তায় দ্রুত বেগে হাঁটছি। কয়েকটি টিমকে টপকে আমি দ্রুত ছুটিছি আর ছুটছি! টিমের দেখা নাই। এক পর্যায়ে আমি খুব ক্লান্ত হয়ে যাই। পিপাসায় গলা শুকিয়ে কাঠ।

একটু থামলাম, আমার ব্যাগের ইমারজেন্সি পানি কাজে লাগল।

এখানে বলে রাখি টিম হতে বিচ্ছিন্ন হওয়া একদমই ঠিক না। আর ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওযে হতে সকাল ১০/১১ টার দিকে মেইন ঝর্ণার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া উচিত কারন তখন অনেক পর্যটকের আনাগোনা থাকে। যদিও কোন নিরাপত্তাহীনতার কথা শুনিনি তবুও নিজের নিরাপত্তা নিয়ে সবসময় অধিকতর সচেতন থাকা উচিৎ।

খৈয়াছড়ার দুর্গম কাঁদাযুক্ত পথ

বন-বাদাড়ের মধ্য দিয়ে সর্পিল রাস্তা। একদিকে যেমন উচুনীচ অন্যদিকে খুবই কর্দমক্ত। সাথে কাঁদার মধে্য আছে গাছের শিকল, পাথরের কুচি ইত্যাদি। আর আছে পাহাড়ী জোঁক। তাই গোলাপের যেমন কাটা আছে তেমনি খৈয়াছড়া ঝর্নার অপরুপ সৌন্দর্য দেখতে গেলে অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়েই পৌছাতে হয় মুল গন্তবে।

ভয়ঙ্কর সুন্দর পহাড়ী পথ

পথে চলতে চলতে ছোট বড় দল বাধা পর্যটকদের চোখে পড়ছে। কেউ বা আবার ফিরেও আসছে। তবে আমার টিমের দেখা নাই।

বর্ষায় নতুন সাজে বন-বনানী

এদিকে সবুজ বন আর পাশ দিয়ে বয়ে চলা ঝর্না ধারার কল-কল শব্দ শুনতে শুনতে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা।

পথিমধ্যে কোন কোন স্থানে ঝর্ণা হতে বয়ে আসা পরিস্কার পানি সংগ্রহ করছে স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য।

স্পষ্টতই, বর্ষার জলে পাহাড়ী গাছ আর প্রকৃতি যেন নতুন রুপে সেজেছে আর সেই রুপ উপভোগের জন্য ছুটে আসছে শত শত পর্যটক।

ঝর্নার পথে নারী পর্যটকও কম নয়

কাঁদা আর পানিতে ভিজে পাথুরে রাস্তা খুবই পিচ্ছিল থাকে তাই খুব সাবধানে চলাচল করা দরকার।

প্রকৃতির সৌন্দর্য কখনও কখনও উদাষ করে

প্রিয় পাঠক, অবশেষে খৈয়াছড়া ঝর্ণার একেবারেই কাছে আসার পরে আমার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া টিম এর দেখা পেয়েছি। তাদের কিছুক্ষন বিলম্ব এবং হোটেল বয়ের ভুল তথ্য দেওয়ার কারনে এমনটা হয়েছে। এতক্ষন পরে এসে তারা ফটোসেশনে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। 

ক্যামেরায় ধরা খাইছে ৪ যাযাবর

এই যে কাজলের মত ফর্সা যে চাঁদমখ খানা দেখতে পাচ্ছেন উনি মিঃ মুনীর ওরফে স্বন্দ্বীপ মুনির। ১০০ টাকা ভাড়ায় ওনাকে গাইড হিসাবে নেওয়া হয়েছে। বিশেষ বিবেচনায় তার দুপুরের খাবার ফ্রি। কিন্তু জাতীয় ড্রেস লুঙ্গি পরা, আর দায়িত্বে চরম ব্যার্থতার দায়ে তাকে ১০০০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সুতরাং ওনাকে গাইড হিসাবে পাওয়ার ব্যার্থ চেষ্টা না করার জন্য আপনাদের ধন্যবাদ।  

যাহোক, অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আমরা চলে এসেছি কাংখিত খৈয়াছড়া ঝর্ণার মুল গন্তব্যে। এখানে যেমন এসেছে শিশুরা, তেমনি এক ঝাক তরুন আর আমাদের মত বয়স্করাও। পুরুষ পর্যটকদের পাশাপাশি নারীদের উপস্থিতিও চোখে পড়ার মত। চারিদিকে পাহাড়ে ঘেরা ঝর্ণার রিনিঝিনি শব্দ, পাখির কলরব, ঝিঝি’র ডাক আর আনন্দে আত্মহারা মানুষের চিৎকার চেচামেচিতে পাহাড়ী বন যে জেগে উছেছে অন্য এক আমেজে।

অপরুপ উচ্ছলতায় ঝর্ণা
উচ্ছল ঝর্ণায় উদ্দাম পর্যটক

কবি ঝর্নাকে “পাহাড়ের কান্না” বলে মনে হয় ভুলই করেছেন। আমার তো তাই মনে হয়। পাহাড়ের রিনিঝিনি নৃত্য আর হাসির ঝলকের সমন্বয়েই ঝর্নার সৃষ্টি।

ঝর্নার জলে অবগাহন
ঝর্নার জলে অবগাহন
ঝর্নার জলে উচ্ছল তারুন্য

ঝর্নাকে পাহাড়ের হাসি বা “কান্না” যাই বলি না কেন ঝর্ণা কিন্তু আমাদের প্রাকৃকি সৌন্দর্যের উৎস আর আনন্দের খোরাক।

তাই আসুন খৈয়াছড়ায়, দেখুন প্রকৃতি, জানুন দেশ, ভালবাসুন বাংলাদেশ ।

এতক্ষন আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

আল্লাহ হাফেজ।

আসসালামু আলাইকুম। 

Our Social Channels:

Blog: VromonBangla

Facebook.com/Travell2Life

Youtube.com

Instagram.com/Travell2life

Twitter.com/Travell2Life

Pinterest.com/Travel2Life